ধর্ম ও জীবন ডেস্কঃ মাহে রমজান সবর বা ধৈর্য ধারণের মাস। রোজাদার ব্যক্তি
কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ করে সব ধরনের পাপাচার, পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকেন। আর এর বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে অতুলনীয়
শান্তির আবাস বেহেশত। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য
ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও। (সূরা আলে-ইমরান-২০০)। সবর মুমিনের জন্য গৃহপালিত জন্তু, খুঁটির মধ্যে বেঁধে রাখার মতো। ইচ্ছামতো এদিক- সেদিক ঘোরে; কিন্তু পরিশেষে তাকে সেই খুঁটির কাছেই ফিরে আসতে হয়। সবর ইমানের শেকড়রে মতো। বৃক্ষ যেভাবে শেকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে ইমানও তদ্রুপ সবরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাই যার সবর।নেই তার পূর্ণ ইমান নেই। সবরবিহীন ইমানদার দ্বিধাগ্রস্ত ইমানদার। এ ধরনের ইমানদার সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ
করেন, মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছে, যারা দ্বিধার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার কোনো কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোনো।বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়।।সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হলো সুস্পষ্ট ক্ষতি। (সূরা হজ-১১)। যে সবর করে, বিপদে ধৈর্য ধারণ করে সেই ভাগ্যবান : পৃথিবীতে যারা সুন্দর জীবন গড়তে পেরেছে, তারা সবরের গুণেই তা গড়েছে। তারা সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে
এই সবরের বদৌলতেই। তারা দুঃসময় এলে ধৈর্য ধারণ করে আর সুসময় এলে আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করে। আর এভাবে তারা সবর ও শোকরের ডানায় চড়ে জান্নাতের অধিকারী হয়। সবর কী? সবরের আভিধানিক অর্থ : ধৈর্য ধারণ করা, বাধা দেয়া বা বিরত রাখা, সহনশীলতা। শরিয়তের পরিভাষায় সবর
বলা হয়থ অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গাল চাপড়ানো ও বুকের কাপড় ছেঁড়া ইত্যাদি থেকে বিরত
রাখা। কারো কারো মতে, এটি হলো মানুষের অন্তর্গত একটি উত্তম স্বভাব, যার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের একটি
অন্তর্গত শক্তি, যা দিয়ে সে নিজকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে। সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদ মোকাবিলা করা। বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে
অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর। ধর্মীয় পরিভাষায় সবর তিন ধরনের। ১. আল্লাহতায়ালার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগি আদায় করতে গিয়ে ধৈর্যধারণ করা। ২. আল্লাহতায়ালার নিষেধ ও তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা এবং ৩. তাকদির ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে তার ওপর ধৈর্যধারণ করা। আল-কুরআনে বর্ণিত লুকমান (আ)-এর বিখ্যাত উপদেশেও এ তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ‘হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ়
সংকল্পের কাজ। (সূরা লুকমান-১৭) তাছাড়া শরিয়তের দৃষ্টিতেও ‘সৎকাজের আদেশ` ও `অসৎকাজে নিষেধ’ বাস্তবায়িত হয় না, যতক্ষণ না আগে সে নিজে তা পালন করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সবর করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিজক প্রদান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভালো কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ পরিণাম। (সূরা রা`দ-১৯-২২) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা নব্বই জায়গায় সবরের কথা বলেছেন। অতএব সবর নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! আল্লাহতায়ালা তার পবিত্র গ্রন্থে সবরকারী তথা ধৈর্যশীলদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের হিসাব ছাড়া প্রতিদান দেবেন বলে উল্লেখ করেছেন। বল, হে আমার বান্দারা যারা ইমান এনেছ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়ায় ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আর আল্লাহর জমিন প্রশস্ত, কেবল ধৈর্যশীলদেরই তাদের প্রতিদান পূণরুপে দেয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই। (সূরা জুমার-১০) আল্লাহতায়ালা বলেন, তিনি ধৈর্যশীলদের জন্য হিদায়েত ও সুস্পষ্ট বিজয় নিয়ে তাদের সঙ্গেই আছেন। আরতোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। (সূরা আনফাল-৪৬) আল্লাহতায়ালা সবর ও ইয়াকিনের কারণে মানুষকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেন আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত। (সূরা সাজদাহ-২৪) আল্লাহতায়ালা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সবরই মানুষের জন্য কল্যাণকর। আর যদি তোমরা সবর কর, তবে তাই সবরকারীদের জন্য উত্তম। (সূরা নাহল-১২৬) আল্লাহতায়ালা সংবাদ দিয়েছেন
যে, কারো যদি সবর থাকে, তাহলে যত বড় শত্রুই হোক তাকে হারাতে পারবে না। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র
তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তারা যা করে, নিশ্চয় আল্লাহ তা পরিবেষ্টনকারী। (সূরা আলে- ইমরান-১২০) আল্লাহতায়ালা বিজয় ও সফলতার জন্য সবর ও তাকওয়া অবলম্বনের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও। (সূরা আলে-ইমরান-২০০) আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলকে ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা,
তাদের যখন বিপদ আক্রমণ করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই।হিদায়াতপ্রাপ্ত। (সূরা বাকারাহ-১৫৫-১৫৭)। ‘নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদের পুরস্কৃত করলাম; নিশ্চয়।তারাই হলো সফলকাম। (সূরা মুমিনূন-১১১) আল্লাহতায়ালা
আল-কুরআনের চারটি স্থানে উল্লেখ করেছেন যে,।তার নিদর্শনাবলি থেকে ধৈর্যশীল ও শোকরগুজার বান্দারাই উপকৃত হয় এবং তারাই সৌভাগ্যবান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, `আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদের
পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে। (সূরা আম্বিয়া-৩৫) আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান কে ধৈর্যশীল, কে মুজাহিদ আর কে সত্যবাদী। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, `তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেননি তাদের, যারা তোমাদের মধ্য থেকে জিহাদ করেছে এবং জানেননি ধৈর্যশীলদের। (সূরা আলে-ইমরান-১৪২) আল্লাহতায়ালা মুমিনকে সম্পদ-সন্তান সবকিছু দিয়েই পরীক্ষা করেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, তোমাদের ধনথসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান। (সূরা তাগাবুন-১৫)