জাগো দেশ ডেস্কঃ কথায় বলে বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। আর এ মুহূর্তে যখন দেশ ও জাতির জন্য কথাটি প্রমাণ করার সময় হয়েছে তখন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে তার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন দিনভিখারি নজিম তার সারা জীবনের সঞ্চয় দান করে আমাদের সমাজে এক অনন্যদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, নাফিসা আন্জুম নামে আমাদেরই এক কন্যা তার বেতনের সবটুকু দিয়ে কর্মহীন মানুষের সাহায্য করায় তার কর্মকাণ্ডে অন্যরা উৎসাহিত হয়ে হাত বাড়িয়ে করোনা মহামারীর এ লকডাউনের সময় কর্মহীন দরিদ্র মানুষের মুখে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করে চলেছেন। আর মানুষ যে মানুষের জন্য এসব উদাহরণ, আমাদের জাতীয় জীবনের বর্তমান সংকটময় অবস্থায় তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
অপরদিকে একশ্রেণির জননেতা দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ত্রাণসামগ্রী লোপাট করে চলেছে! গরিবের মুখের গ্রাস রিলিফের চাল-তেল ইত্যাদি গায়েব করে তারা মাটির নিচে, খাটের বক্সে পর্যন্ত লুকিয়ে রাখছেন! তাছাড়া এসব নেতার গোডাউনেও হাজার হাজার বস্তা রিলিফের চাল ধরা
পড়েছে! দশ টাকা কেজি দরের চাল গায়েব হয়ে যাচ্ছে। যাদের জন্য এ চাল বরাদ্দ করা হয়েছে তারা তা পাচ্ছেন না। এসব চালের ডিলার ভিন্ন নামে, এমনকি মৃত ব্যক্তির নামে এসব চাল বিলিবণ্টন দেখিয়ে কালোবাজারে তা বিক্রি করে দিচ্ছে! বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে এসব খবরাখবর দেখতে
পেয়ে দেশের আমজনতা প্রমাদ গুনছেন! দেশের এ দুর্যোগ মুহূর্তে, জাতির এ বিপদের দিনে এসব চালচোর ত্রাণচোরদের খোদ ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত পশুর চেয়ে
অধম বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এরা কেউ মানুষ নয়’! প্রশাসনও নড়েচড়ে বসে এদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করেছে। অনেকে আবার
সে গ্রেফতারি থেকে ছাড়া পেয়ে মনের আনন্দে সঙ্গী- সাথীসহ ডিসকো নাচ নেচেছেন। আর পাঞ্জাবির ওপরে কালো কোট পরা ওইসব নেতার সেইসব নৃত্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ায় দেশের মানুষের পাশাপাশি আমরাও তা দেখতে পেয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। বিস্মিত হয়েছি এ কারণে যে,
একজন চালচোর কতটা বেহায়া, কতটা বেপরোয়া হলে জামিনে ছাড়া পেয়ে একটি বিশেষ কোট পরে এমন নর্তনকুর্দন করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, নির্লজ্জতারও তো একটা সীমা থাকে, নাকি? উপরিউক্ত অবস্থায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই এখন দেশের মানুষের কাছে আশ্রয় এবং ভরসার একমাত্র স্থান হয়ে পড়েছেন। তিনি চালচোর, রিলিফচোরদের
কঠোরভাবে দমন করাসহ ইতোমধ্যেই তাদের অনেককে গ্রেফতার করে চালসহ অন্য রিলিফ সামগ্রী বিলিবণ্টনের জন্য প্রতিটি জেলায় একজন সচিবকে দায়িত্ব প্রদান করেছেন। অতঃপর একজন সচিবের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমন্বয়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে এবং হচ্ছে। অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিরা ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হওয়ায়, কর্মহীন দরিদ্র মানুষকে সহায়তা প্রদানে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। দেশের অধিকাংশ জেলার দলীয় হাইকমান্ড (সভাপতি, সেক্রেটারি) যদি নন্দলাল না হয়ে তাদের মাঠপর্যায়ের নেতাদের কাজকর্ম দেখভাল করতেন, তাহলে ওইসব নেতা এতটা হীন, এতটা গর্হিত কাজ করার সাহস পেত না। দিন আনা, দিন খাওয়া কর্মহীন মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খেতে পারত না! আসল ঘটনা হল, আমাদের নেতাদের বেশির ভাগই ধনী বা অতি
ধনী শ্রেণিভুক্ত। সাধারণ মানুষের জন্য প্রলেতারিয়েত চিন্তাচেতনা বা মন-মানসিকতা তাদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় স্বভাবতই বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা নন্দলাল হয়ে ঘরে থাকাটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আমরা শুধু শুধুই ডাক্তার সাহেবদের দোষারোপ করেছি। অথচ এ দুঃসময়ে সাধারণ মানুষের পাশে যাদের থাকার কথা, সেই জনপ্রতিনিধিরা কিন্তু তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করছেন এমনটি নয়! হ্যাঁ, কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। এমন অনেক নেতাকেই দেখেছি বা দেখছি যারা কোমরে গামছা বেঁধে মাঠে নেমেছেন, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে তাদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সেই সঙ্গে আজ এ মুহূর্তে এখনও যারা নন্দলালই হয়ে রইলেন তাদের প্রতি ধিক্কার জানানোও প্রয়োজন বলেই মনে করি। কারণ এসব
নন্দলাল মার্কা নেতার কারণেই আজ এখন পর্যন্ত অনেক এলাকায়ই সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। এ অবস্থায় ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, ওইসব এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থাটা কোথায় গিয়ে
ঠেকেছে! আজ করোনাভাইরাস বা কোভিডের কারণে প্রায় সারা পৃথিবীর
মানুষ ঘরে বসে আছে এ কথাটি সত্যি। কিন্তু তাই বলে ডাক্তার- নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী তাদের তো মৃত্যুভয়ে ঘরে বসে থাকা চলে না। আর তারা ঘরে বসেও নেই। ঘরে বসে নেই অনেক রাজনৈতিক নেতাও। কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব না পেলে
দেশটাই তো অচল হয়ে পড়বে! সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী দিনরাত অতন্দ্রপ্রহরীর মতো কাজ করে গেলেও অন্য অনেক নেতার ক্ষেত্রেই
তেমনটি লক্ষণীয় নয়। অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তালমিলিয়ে সবাই কাজ
করছেন বা করতে পারছেন এমনটি মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের অনেক স্থানেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অন্যথায় এভাবে ত্রাণসামগ্রী চুরি-চামারি লুটপাট হতে পারত না। যাক সেসব কথা। আজকের লেখাটির শিরোনাম
যেহেতু, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে’, সুতরাং সংক্ষিপ্তভাবে সে কথাটি বলেই লেখাটি শেষ করতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এমপি-
মন্ত্রীদের অনেকেই যেখানে এমপির পদ, মন্ত্রীর পদ ছেড়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় ব্রতী হয়েছেন, সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের এ শ্রেণির কে কোথায় কীভাবে কতটা বা কতটুকু কাজ করেছেন বা করছেন তা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। কারণ এ সময়ে তাদের তো আর সাধারণ মানুষের মতো মৃত্যুভয়ে গৃহবন্দি হয়ে থাকার কথা নয়। ভারতের মুম্বাইয়ের মেয়রকে গতকাল দেখা গেল, তিনি
নার্সের পোশাক পরে একটি হাসপাতালে করোনা রোগীদের দেখতে গেছেন, যাতে কিনা, ওই হাসপাতালের নার্সরা তাদের কর্তব্য কর্মে উদ্বুদ্ধ হন। ইংল্যান্ডের সব ডাক্তার এমপি, নিজেদের করোনা রোগীর সেবায় নিয়োজিত করেছেন। অথচ আমাদের দেশেও কোনো কোনো ডাক্তার সাহেব এমপি হয়েছেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তাদের সেভাবে নড়াচড়া লক্ষ করা যাচ্ছে না! সরকারি দল বিরোধী দল
উভয় ক্ষেত্রেই এমনটি দেখা যাচ্ছে। দেশের মানুষের এ দুর্যোগ মুহূর্তে তাদের কল্যাণে মোট কতজন এমপি নাফিসা আন্জুমের মতো দুর্গত মানুষের দ্বারে
দ্বারে ছুটে বেড়াচ্ছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিশ্চয়ই তার তালিকা বা হিসাব আছে! দিনভিখারি নজিমের মতো সারা জীবনের সবটুকু সঞ্চয় নিয়ে কোনো এমপি-মন্ত্রী দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য আগুয়ান সে কথাও মাননীয়
প্রধানমন্ত্রীর জানা আছে। এ অবস্থায় দেশ ও জাতি তথা সারা বিশ্বের এ দুর্যোগ মুহূর্তে যেসব এমপি-মন্ত্রী প্রশংসনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তারা বাদে যেসব এমপি-মন্ত্রী নেতা, নাফিসার কাছে, নজিমের কাছে নিজেদের লজ্জায় ফেলেছেন তাদের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার জন্যই এ লেখা। কারণ চাল-তেলসহ
রিলিফের মালামাল চুরির সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দায়-দায়িত্ব নন্দলালের মতো ঘরে বসে থাকা ওইসব নেতারা এড়াতে পারেন না। বয়স্ক বা অসুস্থ নেতাদের কথা বাদ দিলেও সুস্থসবলদের মধ্যে যেসব নেতা এ সময়ে মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে
মগডালে বসে টুনটন করেছেন, ভবিষ্যতে তাদের নেতৃত্বে রাখা ঠিক হবে কিনা সে বিষয়টিও ভেবে দেখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানানো হল। কারণ মহামারীর এ দুর্দিনে ওই শ্রেণির নেতাদের কেউই একজন নজিমের মতো, একজন নাফিসার মতো মহানুভবতা দেখাতে পারেননি।